শ্যামনগর প্রতিনিধি : ফি বছর পহেলা এপ্রিল সুন্দরবনে মধু ও মোম আহরণ মৌসুম শুরু হয়। ৩০ জুন পর্যন্ত চলে এ মৌসুম। এ বছর পবিত্র ঈদুল ফিতরের কারণে মুধ ও মোম আহরণ মৌসুমের আনুষ্ঠানিক যাত্রা আজ। যদিও পহেলা এপ্রিল চারটি নৌকা বনবিভাগ থেকে পাস নিয়ে সুন্দরবনে ঢুকেছে মধু ও মোম সংগ্রহের জন্য। এ সংক্রান্ত একটি খবর গত ৫ এপ্রিল দৈনিক পত্রদূত পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছেÑ২০২৫সালের মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ১৫শ’ কুইন্টাল ও মোমের লক্ষ্যমাত্রা ৪০০ কুইন্টাল। পহেলা এপ্রিল বুড়িগোয়ালিনী ও কোবাদক স্টেশন থেকে ৯টি পাশ সংগ্রহ করেছে মৌয়ালরা। এরমধ্যে সকালে ৪টি নৌকা সুন্দরবনে প্রবেশ করেন।মৌয়ালদের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই খবরে আরও বলা হয়Ñঈদের পর আনন্দের সাথে অনেক আশা নিয়ে তারা সুন্দরবনে যাচ্ছেন মধু আহরণের জন্য। কিন্তু তাদের আশঙ্কা অবৈধভাবে সুন্দরবন থেকে যে হারে মধু চুরি হচ্ছে তাতে আশানুরূপ মধু পাবেন কিনা। অল্প জায়গায় মধু আহরণ করে তাদের পরিবার পরিজনের ভরণপোষণ ও মহাজনের চালান ওঠানো কঠিন বলে জানিয়েছেন মৌয়ালরা। আগামীতে তারা অভয়ারণ্যগুলোতে মধু আহরণের অনুমতি দিতে সরকারের প্রতি আহবান জানান। তাদের ভাষ্যমতে, অভয়ারণ্যে থেকে মধু আহরণ না করার ফলে মধু নষ্ট হয়ে যায়।বনবিভাগের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়Ñ২০২২-২৩ অর্থ বছরে সুন্দরবন থেকে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ করেছেন ১০২৩ কুইন্টাল এবং মোম সংগ্রহ করেন ৩০৬.৯০ কুইন্টাল। ২৯০টি পাশের মাধ্যমে ২০৪৬জন মৌয়াল সুন্দরবনে প্রবেশ করে উক্ত মধু ও মোম সংগ্রহ করেন। পরবর্তী ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৩৬৪টি পাশের মাধ্যমে ২৪৭০জন মৌয়াল সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে যায়। তাদের সংগৃহীত মধু ১২৩৫ কুইন্টাল এবং মোম ৩৭০ দশমিক ৫০ কুইন্টাল।এদিকে ৬ এপ্রিল দৈনিক পত্রদূতের অনলাইন ভার্সনে ‘সুন্দরবনে মধু আহরণে মৌয়ালদের আগ্রহ কম’ শিরোনামে আরও একটি খবর প্রকাশ হয়েছে। খবরে বলা হচ্ছেÑসুন্দরবনে মধু আহরণ মৌসুম শুরু হয়েছে। সুন্দরবনের দু’টি বন বিভাগ খুলনা ও বাগেরহাটের ৪টি রেঞ্জ থেকে মধু আহরণ করা হচ্ছে। বাগেরহাটের পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই, খুলনার পশ্চিম বন বিভাগের খুলনা ও সাতক্ষিরা রেঞ্জের স্টেশন থেকে পাস দেয়া শুরু হয়েছে। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জে এ বছর মৌয়াল ও নৌকার সংখ্যা অনেক কম। পাসের সংখ্যা আশানুরূপ না হলে মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে বন বিভাগ। একই অবস্থা চাঁদপাই রেঞ্জেও।সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রানা দেবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়Ñএবার সুন্দরবনে নতুন করে বনদস্যু আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। মৌয়ালদের নিরাপত্তায় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। কোনো নৌকা যদি বনদস্যুদের কবলে পড়ে তাহলে দ্রুত সংশ্লিষ্ট বন অফিসে জানানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে সুন্দরবনে নতুন করে বনদস্যুদের তৎপরতা শুরু হওয়ায় অপহরণের ভয়ে মধু আহরণে মৌয়ালদের আগ্রহ অনেকটাই কম। এর মাঝে আবার বনদস্যুদের ভয়ে লাখ লাখ টাকা দাদন দিয়ে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না মধু ব্যবসায়ীরাও। ফলে এবার মৌয়াল ও নৌকার সংখ্যা অনেকটা কম বলে জানিয়েছে সুন্দরবন বিভাগ।চলতি ২০২৫ মৌসুমে সরকারিভাবে দুই হাজার পাঁচশত কুইন্টাল মধু ও ৭৫০ কুইন্টাল মোম আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে খুলনা রেঞ্জে এক হাজার কুইন্টাল মধু ও ৩৫০ কুইন্টাল মোম এবং সাতক্ষীরা রেঞ্জে দেড় হাজার কুইন্টাল ও মোমের লক্ষ্যমাত্রা ৪০০ কুইন্টাল নির্ধারণ করা হয়েছে। মৌয়ালদের মতে, সুন্দরবনে নতুন করে বনদস্যুদের তৎপরতা শুরু হওয়ায়, অনেকেই এবার মধু আহরণে যাবেন না। বনদস্যুর হাতে অপহৃত হলে মুক্তিপণ হিসেবে ২-৩ লাখ টাকা দিতে হয়। এ কারণে এবার অনেক মৌয়াল নৌকার পাস নেননি। নতুন করে সুন্দরবনে বনদস্যু তৎপরতা শুরু হওয়ায় এখন বনে ঢুকলেই চাঁদা দিতে হচ্ছে। চাঁদা দিতে না পারলে বনজীবীদের অপহরণ ও নির্যাতন করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনে মধু ও মোম সংগ্রহে যান মৌয়ালরা। মৌয়ালদের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে প্রতিটি মৌয়াল পরিবার। আশায় থাকে তারা সংগৃহীত মোম ও মধু বিক্রি করে আগামী দিনগুলো অতিবাহিত করবেন।দেশে মধু উৎপাদনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে সুন্দরবন। ১৮৬০ সাল থেকে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা হয়। বনসংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বংশপরম্পরায় মধু সংগ্রহ করে। এদেরকেই মৌয়াল বলা হয়। দেশে উৎপাদিত মোট মধুর ২০% সুন্দরবনে পাওয়া যায়। সুন্দরবনের সবচেয়ে ভালো মানের মধু খোলসী ফুলের ‘পদ্ম মধু’। মানের দিক থেকে এরপরেই গরান ও গর্জন ফুলের ‘বালিহার মধু’। মৌসুমের একেবারে শেষে আসা কেওড়া ও গেওয়া ফুলের মধু অপেক্ষাকৃত কম সুস্বাদু।দেশের দক্ষিণ উপকূল জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন। প্রাকৃতিক ঢাল হয়ে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে প্রতিনিয়ত সুন্দরবন রক্ষা করে চলেছে উপকূলীয় সাড়ে ৪ কোটি মানুষকে। সুন্দরবন একদিকে যেমন মানুষকে দুর্যোগ থেকে রক্ষা করছে, অন্যদিকে প্রকৃতিপ্রদত্ত এর বিশাল সম্পদ মানুষের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। নানা প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবনকে করেছে সমৃদ্ধ। গোলপাতা, কাঠ, মধু, মৎস্য সম্পদ, পর্যটন এ অঞ্চলের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছে। সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশা। যারা কাঠ কাটে, গোলপাতা সংগ্রহ করে তারা বাওয়ালী, যারা মধু সংগ্রহ করে তারা মৌয়াল। সবগুলো পেশাই খুব ঝুঁকিপূর্ণ। জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘÑএমন এক বিপদসঙ্কুল অবস্থায় বনজীবীরা সুন্দরবনের সম্পদ আহরণ করে থকে। প্রতি বছর বাঘের আক্রমণে অনেক বনজীবী প্রাণ হারায়। সারাদেশে সুন্দরবনের মধুর রয়েছে আলাদা সুনাম। বনের গহীনে ঢুকে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ করে থাকে। কখনো কখনো তাদের বাঘের হামলায় বা বিষধর সাপের কামড়ে প্রাণ হারাতে হয়। কখনো কুমিরের আক্রমণেও তারা মারা যায়। এছাড়া বনদস্যুদের ঝটিকা আক্রমণ তো রয়েছেই। মৌয়ালরা নিরাপদে নির্বিঘেœ মোম ও মধু সংগ্রহ করুক এবং সফল হোক মোম ও মধু সংগ্রহ অভিযানÑএ প্রত্যাশা আমাদের।